দশেরার উৎসবে অসুরের ওপর ভালোর বিজয়ের প্রতীক হিসেবে রাক্ষস রাজা রাবণের কুশপুত্তলিকা পোড়ানো হয়। তবে, মহাকাব্য রামায়ণের খলনায়ক হওয়ার চেয়ে তার কাছে আরও অনেক কিছু রয়েছে। এখানে পৌরাণিক কাহিনী থেকে রাবণ সম্পর্কে আমরা কিছু আকর্ষণীয় তথ্য শেয়ার করছির
১. রাবণ ছিলেন ব্রহ্মার প্রপৌত্র (সন্তানের সন্তান)
রাবণ ছিলেন সৃষ্টিকর্তা ব্রহ্মার প্রপৌত্র। তাঁর পিতা ছিলেন ঋষি বিশ্রাবস, যিনি ব্রহ্মার 10টি মনীষী পুত্রের মধ্যে প্রজাপতি পুলস্ত্যের পুত্র ছিলেন। তাঁর মা ছিলেন কাইকেসী, অসুর বংশের রাজকন্যা এবং সুমালি ও থাটকের কন্যা।
২. রাবণের সৎ ভাই ছিলেন সম্পদের দেবতা (কুবের)
শক্তিশালী রাবণ হিন্দু পুরাণে স্বর্গীয় সম্পদের দেবতা কুবেরের সাথেও সম্পর্কিত ছিল। তারা একই বাবা একই, কিন্তু মা আলাদা। মহাকাব্য রামায়ণের একটি অংশে, রাবণ কুবেরকে লুট করে এবং তার উড়ন্ত রথ, পুষ্পক বিমানে উড়ে চলে যায়।
৩.একজন শিব ভক্ত
রামায়ন এ বর্নীত কাহিনী অনুসারে, রাবণ মহাদেব কে প্রশন্ন করার জন্য তার ধ্যান করে এবং দীর্ঘ দিন ধ্যান করে মহাদেব কে তুষ্ট করতে পারেনা। অতঃপর সে তার ৯টি মাথা একটি একটি করে কেটে ফেলে এবং সে যখন তার দশম মাথা কাটতে যায় তখন মহাদেব সন্তুষ্ট হয়। তারপর মহাদেব তাকে বরদান দেয় মহান শিব ভক্ত হবার। এরপর থেকে রাবন কে মহা শিবভক্ত ও বলা হয়ে থাকে। তারপর থেকে তিনি দীর্ঘ বছর মহাদেব এর ভক্ত হয়ে থাকেন। রাবণ মহাদেব অনুরোধ করেছিলেন যে, তিনি তাকে কৈলাশ পর্বতে সোনার একটি মহল তৈরি করতে দেন, যা তিনি কুবের এবং স্বর্গীয় স্থপতি বিশ্বকর্মার সাহায্যে করেছিলেন। এমন অনেক তথ্য রয়েছে শিবভক্ত রাবন সম্পর্কে।
৪.তিনি শিবের কাছ থেকে লঙ্কা পেয়েছিলেন
পুজোর দক্ষিনা হিসাবে, রাবণ লঙ্কা চেয়েছিলেন, যা তিনি মহাদেবের জন্য নির্মাণ করেছিলেন, গৃহ-উষ্ণতার জন্য পবিত্র যজ্ঞ পরিচালনার জন্য উপহার হিসাবে। এবং কৈলাশ থেকে মহাদেব কে সরিয়ে তিনি লঙ্কা তে প্রতিষ্ঠিত করতে চেয়েছিলেন। যাইহোক, হনুমানই পরে রাবণ রামের সহধর্মিণী সীতাকে অপহরণ করার পর তার জ্বলন্ত লেজ দিয়ে লঙ্কা পুড়িয়ে দিয়েছিলেন।
৫. রাবণ একটি বাদ্যযন্ত্র তৈরি করেছিলেন
রাবণহট্ট নামে পরিচিত সেই যন্ত্র। এই যন্ত্রটি বীণার মতো এবং বলা হয় যে, রাবণ মহাদেবের স্তুতি গাওয়ার জন্য। কথিত আছে যে, মহাদেব এর সাহায্যে এই যন্ত্রের মাধ্যমে তিনি বেদের বানীকে সংগীত আকারে প্রকাশ করছিলেন। তিনি একজন দক্ষ বীণা বাদক ছিলেন বলে কথিত আছে।
৬. তিনি আপনার ধারণার চেয়েও বড় ছিলেন!
যেহেতু আমরা অনেকেই জানি, তিনি ১০,০০ (দশ হাজার) বছর ধরে তপস্যা করেছিলেন। এবং তার তপস্যার মাধ্যমে তিনি ত্রি-দেব কে প্রশন্ন করেছিলেন। আর এজন্য ধারনা করা হয় তার বয়স ছিল অন্তত। যখন তিনি রামের সাথে যুদ্ধ করেছিলেন তখনও তার সঠিক বয়স জানা যায়নি।
৭. রাবন রামের জন্য যজ্ঞ করেছিলেন
রামায়ণের অনেকগুলি সংস্করণের মধ্যে একটিতে বলা হয়েছে যে, একবার রামের বানরসেনা লঙ্কায় সেতু তৈরি করেছিলো। আর তাদের মহাদেবের আশীর্বাদ এর দরকার ছিলো। যার জন্য তারা একটি যজ্ঞ স্থাপন করেছিল।
কিন্তু সমগ্র অঞ্চলে শিবের সবচেয়ে বড় ভক্ত ছিলেন রাবণ, এবং যেহেতু তিনি অর্ধ-ব্রাহ্মণ ছিলেন, তাই তিনি যজ্ঞ করার জন্যও তিনিই যোগ্য ছিলেন। পরে রাবন রামকে আর মহাদেবকে সম্মান প্রদর্শন করে যজ্ঞ করলেন এবং রামকে তাঁর আশীর্বাদ দিলেন।
৮.রাবন নামের পেছনে ইতিহাস
রাবণ চেয়েছিলেন মহাদেবকে কৈলাস থেকে লঙ্কায় স্থানান্তরিত করতে, এবং এটি সম্ভব করার জন্য, কৈলাশ পর্বতটি উত্তোলনের চেষ্টা করেছিলেন। কিন্তু মহাদেব তিনি তাঁর পা পর্বতে স্পর্শ করেলন, এইভাবে রাবনের হাতের আঙুল পিষে গেলো।
রাবন প্রচন্ড বেদনার গর্জন ছেড়ে দিয়েছিলেন, কিন্তু একই সাথে, তিনি মহাদেবের শক্তিতে মোহিত হয়েছিলেন, তিনি শিব তান্ডব স্টোট্রাম শুরু করে দিয়েছিলেন। এটা বিশ্বাস করা হয় যে রাবণ তার নিজের হাত থেকে নার্ভ বের করে দিয়েছিলেন সঙ্গীতের সাথে যোগ করার জন্য। শিব এইভাবে মুগ্ধ হয়ে তাঁর নাম রাখেন রাবন রাবন নামের অর্থ হলোঃ যে উচ্চস্বরে গর্জন করে।
৯. রাবণ ও কুম্ভকরণ বিষ্ণুর দুয়ারপাল ছিলেন
রাবণ এবং তার ভাই কুম্ভকরণ আসলে জয়া এবং বিজয়া যারা বিষ্ণু দেবের দুয়ারপাল (দারোয়ান)।
এটা তাদের একটু অহংকারী করে তুলেছিল। তারা এতটাই অহংকারী হয় যে একবার যখন চার কুমার ব্রাহ্মন (ব্রহ্মার মন-জাত পুত্ররা) বৈকুণ্ঠের (বিষ্ণুর আবাসস্থল) দ্বারে উপস্থিত হয়েছিল,
তখন জয়া-বিজয়া তাদের নগ্ন সন্তান বলে মনে করেছিলেন (তাদের তপস্যার ফল)। এতে ঋষিরা খুব ক্ষুব্ধ হন, তারা জয়া-বিজয়াকে অভিশাপ দেন যে তারা তাদের প্রভুর কাছ থেকে বিচ্ছিন্ন হবেন।
যখন তারা ক্ষমা চেয়েছিল, ঋষিরা বলেছিলেন যে তারা হয় সাতটি জীবন পৃথিবীতে বিষ্ণুর অবতারের মিত্র হিসাবে বা তিন জীবন তাদের শত্রু হিসাবে কাটাতে পারে। তারা স্বাভাবিকভাবেই পরবর্তীটি বেছে নিয়েছে। এই তিনটি জীবনের একটিতে, জয়া-বিজয়া রাবণ এবং কুম্ভকরণ হিসাবে জন্মগ্রহণ করেছিলেন।
১০. রাবনের দশটি মাথা
রামায়ণের কিছু সংস্করণ বলে যে রাবনের আসলে দশটি মাথা ছিল না, তবে এটি দেখা গেছে কারণ তার মা তাকে নয়টি মুক্তোর একটি নেকলেস দিয়েছিলেন যা যে কোনও পর্যবেক্ষকের জন্য একটি দৃষ্টিশক্তির বিভ্রম সৃষ্টি করেছিল। অন্য সংস্করণে, বলা হয়েছে যে শিবকে খুশি করার জন্য, রাবন তার নিজের মাথাকে টুকরো টুকরো করে কেটেছিল, কিন্তু তার ভক্তি প্রতিটি টুকরোকে অন্য একটি মাথায় তৈরি করেছিল।
দশটি মাথার জন্যই রাবণের আরেক নাম দশানন। অনেকের মতে, রাবণের ১০টি মাথা- ৪টি বেদ এবং ৬টি শাস্ত্রের প্রতীক। রাবণের দশটি মাথা তার দশটি চারিত্রিক বৈশিষ্টে্যর প্রতীক। মহাজ্ঞানী হওয়া সত্ত্বেও চারত্রিক অবনতির কারণে শ্রীরামের কাছে তার পতন হতে হয়।
জেনে নেয়া যাক রাবণের দশ মাথার তাৎপর্য–
- প্রথম মাথা– কাম।। যার বশবর্তী হয়ে রাবণ সীতা মাতাকে হরণ করেছিলেন।
- দ্বিতীয় মাথা– মদমত্ততা।। নিজের জ্ঞানের উপর অতিরিক্ত বিশ্বাস। যাকে ইংরেজিতে ‘’ওভার কনফিডেন্স’’ বলা হয়।
- তৃতীয় মাথা– অহংকার।। নিজেই সেরা এমন মনোভাব। যার কারণে রাবণ ভাই বিভীষণ, কুম্ভকর্ণ এমনকি পুত্র ইন্দ্রজিতের কথাতেও কান না দিয়ে রামের বিরুদ্ধে যুদ্ধ চালিয়ে যান।
- চতুর্থ মাথা– লোভ।। রাবণের লোভের কোনো সীমা পরিসীমা ছিল না। যার ফলে শুধু পরস্ত্রী সীতাকে হরণ করেই ক্ষান্ত হননি, তাঁকে অশোক বনে বন্দী বানিয়ে রেখেছিলেন।
- পঞ্চম মাথা– ক্রোধ।। ক্রোধের বশবর্তী হয়ে রাবণ সত্য-মিথ্যা বিচার না করে শুধু শূর্পনখার কথাতেই প্রতিশোধস্পৃহায় পাগল হয়ে গিয়েছিলেন।
- ষষ্ঠ মাথা– মোহ।। জাগতিক সমস্ত কিছুর প্রতিই মাত্রাতিরিক্ত টান এবং সেই মোহ বজায় রাখতে যত নীচেই নামতে হোক না কেন, রাবণ তাতেও রাজি। বালির সঙ্গে যুদ্ধই তার প্রমাণ।
- সপ্তম মাথা– মাৎসর্য।। রাবণের মনে সহজেই হিংসা জন্মাতো। যার ফলে পরের জিনিস হস্তগত করতেও বাধেনি তাঁর। লঙ্কার সিংহাসন থেকে ভাই কুবেরকে সরিয়ে নিজে রাজা হয়ে বসেছিলেন এই মাৎসর্যের বশবর্তী হয়েই।
- অষ্টম মাথা– জড়তা।। নিজের অহংকার এবং লোভ এমন জায়গায় পৌঁছেছিল, যাতে অন্যের আবেগ ভালোবাসাও তাঁর কাছে গুরুত্বহীন হয়ে যেত।
- নবম মাথা– ঘৃণা।। এই রিপুর বশবর্তী হয়েই রাবণ বিভীষণকে লাথি মারেন।
- দশম মাথা– ভয়।। এটা নিজের অবস্থা, সম্পত্তি হারানোর ভয়। যার ফলে রাবণ ভুল পদক্ষেপ নিতে বাধ্য হয়েছিলেন।
রাবণের এই ১০টি মাথা জাগতিক সমস্ত চাহিদার প্রতি তাকে কামনা বাসনায় ভরিয়ে তাকে জর্জরিত তোলে। যার ফলে, অসীম জ্ঞানী হওয়া সত্ত্বেও সপরিবারে তার পতন হয়।
রামায়নে রাবণ একজন রাক্ষস, কিন্তু এটি একটি অত্যন্ত প্রয়োজনীয় রাক্ষসের ভূমিকা ছিল, যা সৃষ্টির সমীকরণে ভারসাম্য এনেছিল। আশ্চর্যের কিছু নেই যে, পৃথিবীতে অনেক মানুষ আছে, যারা এখনও রাবনের পূজা করে।